আরেকটি সুন্দরবন কি আমরা সৃষ্টি করতে পারব ?

সম্পাদকীয়: আরেকটি সুন্দরবন কি আমরা সৃষ্টি করতে পারব?

 ঢাকার ডাক ডেস্ক: ঘূর্ণিঝড় রেমালের আঘাতে লন্ডভন্ড হয়ে গেছে পুরো উপকূলীয় অঞ্চল। সিডর, আইলার ভয়াবহ ধ্বংসযজ্ঞের পর রেমালের আঘাত একই ধরনের হয়েছে। আবহাওয়াবিদ জলবায়ুবিশেষজ্ঞরা বলেছেন, গত দেড় দশকের মধ্যে উপকূলে আঘাত হানা ঘূর্ণিঝড়গুলোর মধ্যে প্রভাব বিস্তারের দিক থেকে রেমাল ব্যতিক্রমী। রেমালের প্রভাব অন্তত ৪০ ঘন্টা পর্যন্ত ছিল। এর আগে ২০০৯ সালে ভূখন্ডে আইলার প্রভাব ছিল প্রায় ৩০ ঘন্টা। ২০০৭ সালে সিডরের প্রভাব ছিল ১৬ ঘন্টা এবং ২০২২ সালে সিত্রাংয়ের প্রভাব ছিল ১০ ঘন্টা। গত বছর মোখার প্রভাব ছিল সবচেয়ে কম ঘন্টা। তবে এসব ঘূর্ণিঝড়ের প্রবল আঘাত এবং প্রভাব কমাতে সবচেয়ে বেশি ভূমিকা পালন করে সুন্দরবন। সুন্দরবন না থাকলে এগুলোর প্রকৃত যে গতি এবং শক্তি, সে অনুযায়ী আঘাত হানলে বাংলাদেশের উপকূলীয় অঞ্চল বলে কিছু থাকত না। আবহাওয়াবিদরা বলছেন, এবারও রেমেলের ভয়ংকর শক্তি সুন্দরবন ঠেকিয়ে দিয়েছে। যে ক্ষতি হয়েছে, তার চেয়ে আরও বেশি ক্ষতি থেকে বাঁচিয়ে দিয়েছে। পরিসংখ্যান অনুযায়ী, বিগত ৭৫ বছরে বঙ্গোপসাগরে ১৫১টি ঘূর্ণিঝড় সৃষ্টি হয়েছে। এর মধ্যে বেশিরভাগই উপকূলীয় অঞ্চলে আঘাত হেনেছে এবং সেগুলোর শক্তি খর্ব করে দিয়েছে সুন্দরবন। প্রকৃতির এই অপার দান সুন্দরবন উপকূল অঞ্চলে রক্ষাকবচ হয়ে রয়েছে। সুন্দরবনের বৈচিত্র নতুন করে বলার কিছু নেই। এটি বিশ্বের একমাত্র ম্যানগ্রোভ বন এবং বিশ্ব ঐতিহ্য হিসেবে পরিচিত বাংলাদেশই একমাত্র দেশ যেখানে সুন্দরবন কক্সবাজার অঞ্চলে ম্যানগ্রোভ বন রয়েছে। প্রায় ১০ হাজার বর্গকিলোমিটার আয়তনের সুন্দরবনের বর্গকিলোমিটারের বেশি বাংলাদেশে অবস্থিত। বৃহত্তর খুলনায় এর অবস্থান। বাগেরহাট, পুটুয়াখালি, বরগুনা, সাতক্ষীরার অনতিদূরে অবস্থিত। সাধারণত দেশের উপকূলের যে অঞ্চল দিয়ে ঘূর্ণিঝড় আঘাত হানে তার মুখেই সুন্দরবন দাঁড়িয়ে আছে। যেন ঘূর্ণিঝড় ঠেকাতে অতন্দ্র প্রহরী হয়ে রয়েছে। দুঃখের বিষয়, যে সুন্দরবন বারবার ভয়ংকর ঘূর্ণিঝড় ঠেকিয়ে ক্ষয়ক্ষতি কমিয়ে দিচ্ছে, তাই আমরা অবিবেচকের মতো ধ্বংস করে দিচ্ছি। প্রতিনিয়ত এর পরিবেশ, প্রতিবেশের ক্ষতি করছি। একশ্রেণীর মানুষ নির্বিচারে এর গাছপালা কাটা, এর জায়গা দখল করে স্থাপনা নির্মাণসহ এর দূষণ করে চলেছে। এর জীববৈচিত্র হুমকির মুখে ঠেলে দিচ্ছে। প্রায়ই এর ভেতর বিষাক্ত কেমিক্যাল তেলবাহী জাহাজ ডুবতে দেখা যায়। এই বিষাক্ত তেল সুন্দরবনের ভেতর ছড়িয়ে এর পরিবেশের মারাত্মক ক্ষতি করছে। কয়েক দিন আগে সুন্দরবনে আগুন লেগে এর পরিবেশের ব্যাপক ক্ষতি সাধন করে সুন্দরবনকে যেমন খুশি তেমন ব্যবহার করে এর যে ক্ষতি করা হচ্ছে, তাতে বনের অস্তিত্ব হুমকির মুখে রয়েছে বলে পরিবেশবিদরা মনে করছেন। অথচ পৃথিবীতে সুন্দরবন একটিই। এটি মহান আল্লাহর বিশেষ দান। এটি ধ্বংস হয়ে গেলে, আরেকটি সুন্দরবন কি মানুষের পক্ষে তৈরি করা সম্ভব হবে? যে সুন্দরবন আইলা, সিডরের মতো ভয়াবহ ঘূর্ণিঝড়কে দুর্বল করে ব্যাপক ক্ষতি থেকে রক্ষা করেছে এবং সর্বশেষ রেমালের ব্যাপক তান্ডব কমিয়েছে, সেই সুন্দরবন রক্ষায় তেমন কোনো পরিকল্পিত উদ্যোগ নেই। বিষয়টি এমন হয়ে দাঁড়িয়েছে, সুন্দরবন প্রকৃতির দান এবং প্রাকৃতিকভাবেই তা রক্ষা পাবে। ধারণা যে ভুল, তা আমরা প্রতিনিয়ত দেশের সংরক্ষিত বন থেকে শুরু করে পাহাড় কেটে ধ্বংস করা থেকে বুঝতে পারি। যেসব এলাকার বন পাহাড় কেটে সাফ করে ফেলা হচ্ছে, সেসব এলাকা বিরানভূমিতে পরিণত হচ্ছে। সেখানে আর প্রাকৃতিকভাবে বন পাহাড় গড়ে উঠছে না। একইভাবে সুন্দরবন যেভাবে নির্বিচারে ধ্বংস করা হচ্ছে, তা যে একসময় বিলুপ্ত হয়ে যাবে, তাতে সন্দেহ নেই। বন, পরিবেশ জলবায়ুবিষয়ক মন্ত্রী সাবের হোসেন চৌধুরী দায়িত্ব গ্রহণের পরপরই পরিবেশের ক্ষতিসাধনের বিষয়টি উপলব্ধি করে তা রক্ষায় বিভিন্ন উদ্যোগের কথা বলে ১০০ দিনের কর্মসূচি ঘোষণা করেছিলেন। তার ঘোষণা অত্যন্ত ইতিবাচক ছিল। তবে ১০০ দিন পার হয়ে গেলেও তার ঘোষণার উল্লেখযোগ্য কোনো পরিকল্পনা বাস্তবায়ন হয়েছে বলে পরিলক্ষিত হয়নি। বরং আমরা প্রায় প্রতিদিনই পত্রপত্রিকার প্রতিবেদনে বন পাহাড় কেটে উজাড় করে ফেলার খবর পাচ্ছি। এসব বন্ধে মন্ত্রী কোনো উদ্যোগ নিয়েছেন কিনা, কিংবা এর সাথে জড়িতদের বিরুদ্ধে কোনো ব্যবস্থা নিয়েছেন কিনা, তা জানা যায়নি। জলবায়ু পরিবর্তনের কারণে শীর্ষ দশটি ঝুঁকিপূর্ণ দেশের তালিকায় বাংলাদেশ রয়েছে। নিয়ে আবহাওয়া পরিবেশবিদদের মধ্যে উদ্বেগ পরিলক্ষিত হলেও সরকারের তরফ থেকে তেমন কোনো উদ্যোগ পরিলক্ষিত হচ্ছে না। ঝড়ঝঞ্ঝা থেকে উপকূলীয় অঞ্চলে বৃক্ষরোপন করে প্যারাবন সৃষ্টির কথা থাকলেও তা বাস্তবায়ন খুব একটা হচ্ছে বলে মনে হয় না। বরং সংবাদ পাওয়া যায়, নতুন করে প্যারাবন সৃষ্টির পরিবর্তে উল্টো বিদ্যমান প্যারাবনের বৃক্ষনিধন করা হচ্ছে। অথচ ঘূর্ণিঝড়ের আঘাত সামাল দেয়ার জন্য উপকূলীয় অঞ্চলে ব্যাপকহারে প্যারাবন সৃষ্টি করা অপরিহার্য। প্রাকৃতিকভাবে প্যারাবন হয়ে থাকা সুন্দরবন একাই ঘূর্ণিঝড়ের ব্যাপক তান্ডব থেকে রক্ষা করছে। বারবার রক্ষা করে এর গুরুত্ব স্মরণ করিয়ে দিচ্ছে। এর প্রাকৃতিক ভারসাম্য রক্ষা করতে না পারলে ঝড় সামাল দেয়ার সক্ষমতা একসময় থাকবে না। তখন কী পরিস্থিতি দাঁড়াবে, তা কল্পনাও করা যায় না।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *