গত জুলাই ও আগস্ট মাসে বাংলাদেশে ঘটে যাওয়া গণহত্যা

অনলাইন ডেস্ক: প্রথমে কোটা এবং তারপর সরকার পতনের আন্দোলনকে কেন্দ্র করে গত জুলাই ও আগস্ট মাসে বাংলাদেশে ঘটে যাওয়া হত্যাকাণ্ডকে ‘জুলাই গণহত্যা’ হিসেবে বর্ণনা করেছেন আইন বিচার ও সংসদ বিষয়ক মন্ত্রণালয়ের উপদেষ্টা আসিফ নজরুল।

 

আর এই সময়ে অন্তত ৬৫০ জন নিহত হয়েছেন বলে জানিয়েছে জাতিসঙ্ঘ।

এদিকে ছাত্র আন্দোলনে ১ হাজারেরও বেশি মানুষের মৃত্যু হয়েছে বলে ভারতীয় গণমাধ্যমে দেয়া একটি সাক্ষাৎকারে মন্তব্য করেছেন সদ্য সাবেক স্বরাষ্ট্র উপদেষ্টা ও বর্তমানে বস্ত্র ও পাট মন্ত্রণালয়ের উপদেষ্টা ব্রিগেডিয়ার জেনারেল (অবসরপ্রাপ্ত) এম সাখাওয়াত হোসেন।

এ সময়ে নিহতদের সংখ্যা নিয়ে বাংলাদেশের একেকটি গণমাধ্যমে একেকরকম সংখ্যা তুলে ধরা হচ্ছে।

মোটাদাগে, আন্দোলনে নিহতের সংখ্যা নিয়ে নানা আলাপ হলেও এর প্রকৃত সংখ্যা নিয়ে ধোঁয়াশা কাটছে না

সেক্ষত্রে নিহতদের সংখ্যা জানার উপায় কী?
মানবাধিকারকর্মীরা বলছেন, নিহতদের সংখ্যা জানার জন্য তালিকা তৈরির কোনো বিকল্প নেই। একইসাথে দোষীদের বিচারের আওতায় আনার জন্যেও নিহতদের তালিকা করা প্রয়োজন।

আন্দোলনে নিহতের সংখ্যা কত?
বাংলাদেশের সাম্প্রতিক বিক্ষোভ ও অস্থিরতা নিয়ে গত শুক্রবার জাতিসঙ্ঘের মানবাধিকারবিষয়ক হাইকমিশনারের দফতর থেকে একটি প্রাথমিক প্রতিবেদন প্রকাশ করা হয়।

১৬ জুলাই থেকে ১১ আগস্ট পর্যন্ত সময়ে বিভিন্ন গণমাধ্যমে প্রকাশিত তথ্যের ভিত্তিতে কমপক্ষে ৬৫০ জনের মৃত্যু হয়েছে বলে প্রতিবেদনে উল্লেখ করা হয়।

এতে বলা হয়, এদের মধ্যে ৪ আগস্ট পর্যন্ত ৪০০ কাছাকাছি এবং বাকি প্রায় ২৫০ জন পরের দুই দিনে প্রাণ হারিয়েছেন।

আর জুন থেকে শুরু হওয়া আন্দোলনে ৩২ শিশুর মৃত্যু হয়েছে বলেও এতে উল্লেখ করা হয়।

একইদিন ভারতের অনলাইনভিত্তিক গণমাধ্যম নর্থইস্ট নিউজকে ব্রিগেডিয়ার জেনারেল (অবসরপ্রাপ্ত) এম সাখাওয়াত হোসেন জানান, এই সময়ে নিহত হয়েছে সহস্রাধিক মানুষ।

তিনি বলেন,‘ঢাকার কিছু জায়গায় এবং অন্যান্য জেলায় সাবেক প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার পুলিশ বাহিনী মানুষকে অস্ত্রের আঘাতে বা গুলি করে, যাদের বেশিরভাগই ছিল ছাত্র ও তরুণ।’

অন্তর্বতীকালীন সরকার গঠনের পর তিনি স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের দায়িত্বে ছিলেন। পরে তাকে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয় থেকে সরিয়ে তাকে বস্ত্র ও পাট মন্ত্রণালয়ের দায়িত্ব দেয়া হয়।

যা বলছে বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলন
নির্দিষ্ট কোনো তালিকা করা না হলেও সংঘাতে মৃতের সংখ্যা অন্তত এক থেকে দেড় হাজার হতে পারে বলে মনে করেন বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের সমন্বয়ক উমামা ফাতেমা।

তিনি বলেন, প্রথমেতো ভেবেছিলাম অন্তত ৫০০ হবে। কিন্তু হাসপাতালের ডাটা (উপাত্ত), মানুষের মুখের কথা শুনে এখন মনে হচ্ছে এটা কোনোভাবেই এক থেকে দেড় হাজারের নিচে হবে না। বিশেষ করে যেদিন শেখ হাসিনা পদত্যাগ করলো, সেদিনও দুইশো/আড়াইশোর ওপর লাশ পড়েছে।

এর আগে, কোটা আন্দোলনের সময় ১৬ থেকে ২৫ জুলাই পর্যন্ত সারাদেশে ২৬৬ জনের মৃত্যুর তথ্য প্রকাশ করে বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলন।

এরপর আর নিহতদের নিয়ে নতুন তালিকা করার কোনো কাজ শুরু হয়নি বলে জানান ফাতেমা।

এই সমন্বয়ক বলছেন, নিহতদের অনেকের মৃত্যু ‘হার্ট এটাক, স্ট্রোক, সড়ক দুর্ঘটনা বলে নথিভুক্ত করা হয়েছে, আবার অনেকের মর্গে থাকা লাশ কিংবা বেওয়ারিশ হিসেবে দাফন হয়েছে।

ফলে সারা দেশব্যাপী অনুসন্ধান করে তালিকা করা বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের জন্য ‘অনেক বড় দায়িত্ব’।

আর তাই ‘সরকারের লোক নিয়োগ করে শহীদদের তালিকা তৈরি করা জরুরি’ বলে মনে করেন তিনি।

ফাতেমা বলেন, আমরা আমাদের জায়গা থেকে বলছি যে সরকারিভাবে উদ্যোগটা নিতে হবে। অন্তর্বর্তী সরকারের অধীনে টিম গঠন করে শহীদদের সংখ্যাটা আইডেন্টিফাই (চিহ্নিত) করা খুব দরকার।

এদিকে হত্যাকাণ্ডের সাথে জড়িতদের আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল আইন ১৯৭৩ অনুযায়ী বিচার করা হবে বলে গণমাধ্যমে জানান আইন বিচার ও সংসদ বিষয়ক মন্ত্রণালয়ের উপদেষ্টা আসিফ নজরুল।

তবে নিহতদের তালিকা করার বিষয়ে সরকারের পক্ষ থেকে এখন পর্যন্ত কিছু বলা হয়নি।

এই আন্দোলনে কত মানুষ নিহত বা আহত হয়েছে, সেটা জানতে সরকারের তরফ থেকে এখনো কোনো উদ্যোগের কথা জানা যায়নি।

এ নিয়ে সরকারের তরফ থেকে কোনো উদ্যোগ নেয়া হয়েছে কিনা বা কোনো পরিকল্পনা করা হচ্ছে কিনা জানতে বিবিসি বাংলার পক্ষ থেকে একাধিক উপদেষ্টার সাথে যোগাযোগের চেষ্টা করা হলেও কোনো মন্তব্য পাওয়া যায়নি।

প্রকৃত সংখ্যা কি জানা সম্ভব?
আন্দোলন চলাকালীন নিহত অনেকের তথ্যই হাসপাতালে নথিভুক্ত করা হয়নি। আবার ময়নাতদন্ত ছাড়াই অনেকের লাশ নিয়ে গেছেন স্বজনরা। থানাগুলোতেও নেই প্রকৃত মৃতের সংখ্যা।

এমন প্রেক্ষাপটে কেবল নথিবদ্ধ তথ্যগুলোই প্রকাশিত হচ্ছে। সেক্ষেত্রে মৃতের প্রকৃত সংখ্যা পাওয়া যাওয়ার সুযোগ কম বলেই মনে করছেন মানবাধিকারকর্মী নূর খান লিটন।

তিনি বলেন, প্রথম দিকে পাখির মতো মানুষ মেরেছে, যুদ্ধক্ষেত্রে যে ধরনের মারণাস্ত্র ব্যবহার করা হতো সেগুলো অনেকটা ব্যবহার হয়েছে এবং সেই সময় এত বেশি মৃত ও আহতের সংখ্যা যে হাসপাতালগুলো সামাল দিতে পারছিলো না।

তিনি আরো বলেন, অনেক ক্ষেত্রে আত্মীয়রা লাশ নিয়ে চলে গেছে, আবার আইনশৃঙ্খলা বাহিনী কিছু লাশ গায়েব করেছে। অনেকে এখনো অজ্ঞাত আছে।

এছাড়াও ঢাকায় ভাসমান জনগোষ্ঠী আছে। ফলে তাদের শনাক্ত করতে সময় লাগবে। ফলে প্রকাশিত কোনো সংখ্যাই হয়তোবা সঠিক না হতে পারে বলে মনে করেন এই মানবাধিকারকর্মী।

আর তাই এমন একটি ঘটনায় ‘অনুমাননির্ভর কথা না বলে কিছু সময় অপেক্ষা করে প্রকৃত সংখ্যা বের করার চেষ্টা করা উচিৎ’ বলেই মত তার।

নিহতদের তালিকা করা কেন জরুরি?
‘বিচারপ্রাপ্তি, ইতিহাসের প্রয়োজন এবং পরিবারগুলোর পাশে দাঁড়াতে’ নিহতদের তালিকা থাকা দরকার বলে মনে করেন মানবাধিকারকর্মী নূর খান লিটন।

অর্থাৎ মানবতাবিরোধী অপরাধ এবং গণহত্যার বিচার করতে চাইলে নিহতদের সম্পর্কে জানা জরুরি বলেই মনে করেন তিনি।

তিনি বলেন, দ্বিতীয়ত ইতিহাসের প্রয়োজনে সংরক্ষণ করা প্রয়োজন। এত বড় নির্মমতা হয়ে গেল এখানে, কত মানুষকে পরিকল্পিতভাবে হত্যা করা হলো সেটি জানাটা আমাদের দরকার।

আর নিহতদের পরিবারের পাশে দাঁড়াতে হলেও এই তালিকা লাগবে বলেও মত তার।

সেক্ষেত্রে কাজ শুরুর পর এক থেকে দেড় মাসের মতো সময় লাগতে বলে ধারণা করেন লিটন।

প্রকৃত সংখ্যা জানতে কী করা যেতে পারে?
নিহতদের প্রকৃত সংখ্যা জানতে সরকার জনগণের কাছে তথ্যের জন্য সাহায্য চাইতে পারে বলে মনে করেন নূর খান লিটন।

তিনি বলেন, এই সময়কালে যারা নিখোঁজ হয়েছেন বা আত্মীয় স্বজনের সন্ধান পাচ্ছেন না তারা যেন সরকারের সাথে যোগাযোগ করে এমন নোটিশ জারি করে সরকারের তরফ থেকে বিজ্ঞাপন দেয়া উচিৎ।

তবে বিজ্ঞাপন দিলেও অনেকের পর্যন্ত তা পৌঁছাতে না পারে। সেক্ষেত্রে বিভিন্ন মানবাধিকার সংস্থা বা পেশাজীবী সংগঠন জনগণের থেকে তথ্য নেয়ার চেষ্টা করতে পারে বলে মত লিটনের।

তিনি বলেন, আমাদের নেটওয়ার্ক আছে। উন্নয়ন সংস্থা বা এনজিও’র কাজ সারা বাংলাদেশে জালের মতো ছড়িয়ে আছে। সবাইকে যদি দ্রুততম সময়ে কাজে লাগানো যায় তাহলে প্রকৃত তথ্য পেতে পাওয়া সম্ভব।

তবে তালিকা করার পরও এর থেকে কিছু সংখ্যা বাদ পড়ার সম্ভাবনা আছে বলেই মনে করেন এই মানবাধিকারকর্মী।

সূত্র : বিবিসি

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *