পাচারের টাকায় ‘দেশকে অস্থিতিশীল করার চেষ্টা’ চালাচ্ছেন হাসিনা ও তার সহযোগীরা : ইইউ রাষ্ট্রদূতদের প্রধান উপদেষ্টা

বাংলাদেশ থেকে ‘পাচার হওয়া টাকা ব্যবহার করে’ দেশকে ‘অস্থিতিশীল করার চেষ্টা করা হচ্ছে’ বলে ইউরোপীয় ইউনিয়নের (ইইউ) রাষ্ট্রদূতদেরকে বলেছেন অন্তর্বর্তী সরকারের প্রধান উপদেষ্টা মুহাম্মদ ইউনূস। ক্ষমতাচ্যুত প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ও তার সহযোগীরা এই চেষ্টা চালাচ্ছেন বলেও অভিযোগ তার। সম্প্রতি বাংলাদেশ সম্পর্কে ‘ব্যাপক আকারে অপতথ্য ছড়ানো হচ্ছে’ উল্লেখ করে প্রধান উপদেষ্টা এই ‘মিসইনফরমেশন’ ঠেকাতে ইউরোপীয় ইউনিয়নের দূতদের সহযোগিতা কামনা করেছেন।

সোমবার (০৯ ডিসেম্বর) দুপুরে রাজধানীর তেজগাঁওয়ে প্রধান উপদেষ্টার কার্যালয়ে মুহাম্মদ ইউনূসের সঙ্গে সাক্ষাৎ করে ইউরোপীয় ইউনিয়নের ১৯ সদস্যের প্রতিনিধি দল।

সেখানে অনুষ্ঠিত বৈঠক প্রধান উপদেষ্টা বলেন, ‘ডিসেম্বর মাসে গোটা মাসজুড়ে আমরা বিজয় উদযাপন করি। বিজয়ের মাসে আপনাদের সঙ্গে এমন একটি ইনটার‌্যাক্টিভ আলোচনায় অংশ নিতে পেরে আমি খুব আনন্দিত।’

এ সময় মুহাম্মদ ইউনূস জুলাই-আগস্টে গণঅভ্যুত্থানে শহীদ ও আহতের প্রতি সম্মান প্রদর্শন করেন।

বৈঠকে ঢাকায় ইউরোপীয় ইউনিয়নভুক্ত ৮টি দেশের এবং ভারতের নয়াদিল্লিতে পাঁচটি মিশনের প্রধানরা অংশ নেন। ছিলেন আরও ছয়টি মিশনের কর্মকর্তারা। তাদের নেতৃত্বে ছিলেন বাংলাদেশে ইউরোপীয় ইউনিয়নের হেড অব ডেলিগেশন মাইকেল মিলার।

বৈঠকে শ্রম অধিকার, বাণিজ্য সুবিধা, জলবায়ু পরিবর্তন, মানবাধিকার, আন্তর্জাতিক অপরাধ (ট্রাইবুনাল) আইন, রোহিঙ্গা প্রত্যাবাসন ও টেকসই ভবিষ্যৎ নির্মাণে উভয়ের অঙ্গীকার ও করণীয় সম্পর্কে আলোচনা হয় বলে প্রধান উপদেষ্টার কার্যালয় থেকে দেয়া এক বিজ্ঞপ্তিতে জানানো হয়।

প্রায় আড়াই ঘণ্টা ধরে চলা এই বৈঠকে ইউরোপীয় ইউনিয়নের ১৫ জন প্রতিনিধি তাদের মতামত তুলে ধরেন।

বিজ্ঞপ্তিতে বলা হয়, বৈঠকে প্রধান উপদেষ্টা গত ১৬ বছর ধরে ‘অত্যাচার, শোষণ, বলপূর্বক গুম, মানবাধিকার লঙ্ঘন’ সম্পর্কে সংক্ষেপে তুলে ধরেন। তিনি অর্থনৈতিক শ্বেতপত্রের বিষয় উল্লেখ করে ‘দুর্নীতি, অর্থপাচার এবং ব্যাংকিং সিস্টেমকে কীভাবে বিপর্যস্ত করা’ হয়েছিল সেসব কথা জানান।

প্রধান উপদেষ্টা রাষ্ট্রদূতদের বলেন, ‘জুলাই গণঅভ্যুত্থানে দেশ থেকে ‘পালিয়ে যেতে বাধ্য হওয়া স্বৈরাচারী’ শেখ হাসিনা ও তার সহযোগীরা যে ‘ব্যাপক টাকা পাচার করে নিয়ে গেছে’, তা দিয়ে তারা দেশকে অস্থিতিশীল করার চেষ্টা করছে।’ সম্প্রীতি ও জাতীয় ঐক্যের লক্ষ্যে বাংলাদেশের ‘সব’ রাজনৈতিক দল ও ধর্মীয় জনগোষ্ঠীর প্রতিনিধিদের সঙ্গে মতবিনিময়ের কথাও তিনি বৈঠকে উল্লেখ। অন্তর্বর্তী সরকারের সংস্কার ও নির্বাচন প্রক্রিয়া সম্পর্কেও ইইউ প্রতিনিধিদের তিনি বিশদভাবে জানান।

বাংলাদেশিদের জন্য ভিসা সেন্টার দিল্লি থেকে সরিয়ে ঢাকায় অথবা প্রতিবেশী অন্য কোনো দেশে স্থানান্তরের অনুরোধও জানান প্রধান উপদেষ্টা। তিনি বলেন, ‘ভারত বাংলাদেশিদের জন্য ভিসা সীমিত করায় অনেক শিক্ষার্থী দিল্লি গিয়ে ইউরোপের ভিসা নিতে পারছেন না। ফলে তাদের শিক্ষাজীবন নিয়ে অনিশ্চয়তা তৈরি হয়েছে। ইউরোপের বিশ্ববিদ্যালয়গুলো বাংলাদেশের শিক্ষার্থী পাচ্ছে না। ভিসা অফিস ঢাকা অথবা প্রতিবেশী কোনো দেশে স্থানান্তর হলে বাংলাদেশ এবং ইউরোপীয় ইউনিয়ন উভয়ই উপকৃত হবে।’

প্রধান উপদেষ্টার সঙ্গে বৈঠকে অংশ নেন পররাষ্ট্র উপদেষ্টা তৌহিদ হোসেন। তিনি জানান, ইতোমধ্যে বুলগেরিয়া বাংলাদেশিদের জন্য তাদের ভিসা সেন্টার ইন্দোনেশিয়া ও ভিয়েতনামে স্থানান্তর করেছে।

বাংলাদেশের জ্বালানি খাতের রূপান্তরে সহযোগিতার জন্য ইউরোপীয় ইউনিয়নের প্রতি আহ্বান জানান প্রধান উপদেষ্টা। তিনি বলেন, ‘আমরা আমাদের জ্বালানি খাতের রূপান্তরে সহায়তা প্রদানের জন্য অন্যান্য দেশের সঙ্গেও কথা বলেছি। এ বিষয়ে আপনাদের সহযোগিতাও প্রত্যাশা করছি।’

মুহাম্মদ ইউনূস বলেন, পরিবেশ অবশ্যই তাদের জন্য সর্বোচ্চ অগ্রাধিকার। বাংলাদেশ পরিবেশ বিপর্যয়ের শিকার উল্লেখ করে তিনি বলেন, ‘একটি ক্ষেত্রে আমি খুবই আগ্রহী হয়ে উঠি- তা হলো নবায়নযোগ্য জ্বালানি।’ তিনি বলেন, এ ক্ষেত্রে বাংলাদেশ নেপালের সঙ্গে একটি সূচনা করতে যাচ্ছে।

চলতি বছরের সেপ্টেম্বরে নিউইয়র্কে জাতিসংঘ সাধারণ পরিষদের অধিবেশনের ফাঁকে ইউরোপীয় কমিশনের প্রেসিডেন্ট উরসুলা ভন ডার লিয়েনের সঙ্গে তার বৈঠকের কথা উল্লেখ করে প্রধান উপদেষ্টা বলেন, যখন তিনি উরসুলা ভন ডার লিয়েনের সঙ্গে কথা বলার সুযোগ পান, তখন নবায়নযোগ্য জ্বালানির বিষয়টি অত্যন্ত জোরালোভাবে উঠে এসেছিল। মুহাম্মদ ইউনূস বলেন, উরসুলা ভন বাংলাদেশের জ্বালানি খাতের রূপান্তরে সব ধরনের প্রযুক্তি সরবরাহের প্রতিশ্রুতি দিয়েছেন।

প্রধান উপদেষ্টার প্রেস উইং থেকে গণমাধ্যমে পাঠানো ছবিতে দেখা যায় ইইউ প্রতিনিধি দলে ছিলেন- ঢাকায় ডেনমার্কের রাষ্ট্রদূত ক্রিশ্চিয়ান ব্রিক্স মোলার, ফ্রান্সের রাষ্ট্রদূত মারি মাসদুপুই, জার্মানির রাষ্ট্রদূত আখিম ট্র্যোস্টার, ইতালির রাষ্ট্রদূত আন্তোনিও আলেসান্দ্রো, স্পেনের রাষ্ট্রদূত গ্যাব্রিয়েল সিসতিয়াগা, সুইডেনের রাষ্ট্রদূত নিকোলাস উইকস, নেদারল্যান্ডসের রাষ্ট্রদূত আন্দ্রে কারস্টেনস।

দিল্লিতে ইউরোপীয় ইউনিয়নের মিশন প্রধানদের মধ্যে ছিলেন- বাংলাদেশে বেলজিয়ামের রাষ্ট্রদূত দিদিয়ের ভান্ডারহাসেল্ট, বুলগেরিয়ার রাষ্ট্রদূত নিকোলাই ইয়ানকোভ, এস্তোনিয়ার রাষ্ট্রদূত মারিয়ে লুপ, লুক্সেমবার্গের রাষ্ট্রদূত পেজি ফ্রান্টজেন, স্লোভাকিয়ার রাষ্ট্রদূত রবার্ট ম্যাক্সিয়ান, সাইপ্রাসের রাষ্ট্রদূত ইভাগোরাস ভ্রায়োনাইডস।

আরও ছিলেন- নয়াদিল্লিতে হাঙ্গেরি দূতাবাসের বাংলাদেশ অফিসের ফার্স্ট সেক্রেটারি, পোল্যান্ডের দূতাবাসের কনস্যুলার, পর্তুগাল দূতাবাসের হেড অব মিশন, স্লোভেনিয়া দূতাবাসের ফার্স্ট সেক্রেটারি এবং নয়াদিল্লিতে রোমানিয়া দূতাবাসের সেকেন্ড সেক্রেটারি।

প্রেস উইংয়ের বিজ্ঞপ্তিতে বলা হয়, ইইউ প্রতিনিধিরা সংস্কার প্রক্রিয়ায় প্রধান উপদেষ্টাকে পূর্ণ সমর্থন জানিয়েছেন। তারা ‘পরামর্শ ও সুপারিশ জানিয়ে নতুন বাংলাদেশ গড়ার লক্ষ্যে পাশে থাকার প্রতিশ্রুতিও দিয়েছেন।alt

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *