কাজী বিপ্লব হাসান: আমাদের সামাজে কিছু মানুষ আছে যাদের কোন কাজকর্ম নেই এবং এরা অলস জীবন যাপন করে থাকে।
তবে এরা যে একেবারেই অকর্ম ভাবে বসে থাকে তা নয়। এরা কিন্তু একটা কাজ করে থাকে এবং সেটি হলো গুজব ছড়ানো। এটি একটি ভয়ঙ্কর অপ কর্ম যা সমাজে বিপত্তি বয়ে আনে। এদের মধ্যে মহিলারাই সর্বাধিক অগ্রগামী এবং এদের মধ্যে বষস্ক বিধবা মহিলার সংখাই বেশি। অনেক বয়স্ক বিধবা মহিলা আছেন যাদের সংসারের কোন দায়ীত্ব নেই। এরা বাড়ি বাড়ি ঘুরে বেড়ায় আর পান চিবায় ও নানা ধরনের গল্প গুজব করে। এর মধ্যে পরচর্চা আর পরনিন্দাই বেশি থাকে। কথার ফাঁকে ফাঁকে সুযোগ বুঝে একটি মিথ্যা গুজব ছেড়ে দেয়। যেমন কোন মহিলার বাচ্চা অসুস্থ থাকলে বলবে, কিলো, তর বাচ্চাটার কী হয়েছে? শুকিয়ে গেছে?
তখন হয়তো উক্ত কম বয়সী মেয়েটি বলল, হ খালা, দাদি বা নানি, বাচ্চাটার কী জানি হয়েছে, কিছুখেতে চায়না, সারাদিন শুধু খ্যান-খ্যান ঘ্যান-ঘ্যান করে।
কোন ব্যবস্থা করছ নাই?
কত ডাক্তার কবিরাজ দেখাইলাম কিন্তু কোন কাজ হচ্ছেনা।
আরে অরে উপরিতে পাইছে, ডাক্তার কবিরাজ দিয়া কাম হইবনা। অরে ফকির দেখা।
সুযোগমত এক ভন্ড ফকিরের নাম করে বলল, আমার জানামতে এক জন বড় ফকির আছে, তুই তার কাছে যা। হের পানি পড়া, তেল পড়া, আর তাবিজের অনেক গুন। কত বড় বড় রোগী হের হাতে ভাল হইয়া গেল।
তখন কুসংস্কারে বিশ্বাসী মহিলাটি তার বাচ্চাকে নিয়ে উক্ত ভন্ড ফকিরের দারস্থ হয় এবং তেল পড়া, পানি পড়া ও তাবিজ দিয়ে উক্ত ভন্ড ফকির মহিলাটির কাছ থেকে বেশকিছুপয়সা হাতিয়ে নেয়। কিন্তু শিশুটির রোগের কোন উন্নয়ন সাধিত হয় না। তবে অনেক সময় মানুষের অনেক রোগ এমনিতেও ভালো হয়ে যায়। তখন ঐ ভন্ড ফকিরের উপর মানুষের বিশেষ করে মহিলাদের বিশ্বাস অনেক বেড়ে যায় এবং তারাও উক্ত ভন্ড ফকিরের মহত্ত প্রচারে ব্যস্ত হয়। কথায় আছে তুফানে বকমরে আর ফকিরের কেরামতি বাড়ে। অনেক সময় এসব ভন্ড ফকিরের হাতে মহিলাদের সমভ্রম খোয়ানোর কথাও কারো অজানা নয়।
অপ্রিয় সত্য হলো আমাদের এদেশ একসময় ছিলো হিন্দু ধর্মালম্বীদের দেশ। এদেশের শতকরা ৯০ ভাগ মুসলমানদেরই পূর্বপুরুষ ছিলো হিন্দু ধর্মালম্বী। তাই হিন্দুসমাজের অনেক কুসংস্কার এখনও এদেশের মুসলমানদের মধ্যে প্রচলিত রয়েছে। যেমন- পরীক্ষা অথবা চাকরির ইন্টারভিউ দিতে যাবার সময় ডিম, গোলআলু, কলা ও দুধ খেতে নেই। তাহলে পরীক্ষায় অথবা উন্টারভিউতে অকৃতকার্য হবে। প্রসংগত ছাত্র-ছাত্রীরা যদি ঠিকমত পড়ালেখা না করে তহলে তারা পরীক্ষায় শুন্য ছাড়া আর কী পাবে? আমাদের সমাজে আরো একটি কুসংস্কার প্রচলিত রোয়েছে তাহলো কেউ যাত্রাপথে দরজার সাথে মাথা ঠেকলে অথবা টিকটিকি ডেকে উঠলে, দরজার চৌকাঠে হেচট খেলে কোহ হাঁচি বা কাশি দিলে, ঘরের পানির কলসি খালি থাকলে কিংবা যাত্রাপথে কোন মানুষের মৃত দেহ দেখলে যাত্রা অশুভো বলে মনে করা হয়। এছাড়া কোন বড় নদীর উপর সেতু তৈরির সময় নরবলি দিতে হবে, নতুবা নদীর উপর উক্ত সেতু নির্মান সম্ভব হবে না। কারন নদীর মালিক দেব-দেবীদের সন্তুষ্ট না করলে অর্থাৎ সেতু জন্য নর বলি নাদিলে নদীর মালিক সেতু তৈরি করতে দিবেনা অথবা সেতু তৈরি হলেও সেটির উপর দিয়ে চলাচলের সময় বিভিন্ন দুর্ঘটনায় অনেক মানুষের প্রানহানি ঘটবে।
পদ্মাসেতু নিয়েও প্রথমে এধরনের একটি কুসংস্কারের গুজব উঠেছিলো। ২০১৮ খ্রিঃ সেটি নির্মানের সময় প্রথম অবস্থায় একটি গুজব উঠেছিলো যে, পদ্মা নদীতে নরবলি নাদিলে পদ্মাসেতু নির্মান সম্ভব হবে না। পরে সেই গুজবটি কোন কারনে ধামাচাপা পড়ে যায়। কিন্তু ২০১৯ সালের প্রথম দিকে সেতুর মাঝ বরাবর পাইলিং করতে গিয়ে দেখাযায় যে, সেখানে গভীর কাদামাটির স্তর থাকায় পাইলিং করা সম্ভব হচ্ছেনা। এসময় গুজব ছরিয়ে পড়ে যে, নদীর মালিক পদ্মানদীর নিচে আরো একটি নদী তৈরি করে দিয়েছে। এজন্য নদীর মালিককে দের শত নরমন্ডু দিয়ে খুসি করতে হবে। তা না হলে পদ্মাসেতু করা সম্ভব হবে না। সেতুনির্মান কাজে নিয়োযিত প্রধান প্রকৌশলিকে (ইঞ্জিনিয়ার) নাকি বিষয়টি স্বপ্নে দেখানো হয়েছে বলে দেশ ব্যপি গুজব ছড়িয়ে পড়লে পদ্মাসেতুর এপ্রান্তে মুন্সীগঞ্জ জেলায় ও অপর প্রান্তে শরীয়ত পুর জেলায় আতঙ্ক ছড়িয়ে পড়ে। গুজব ছড়িয়ে পড়ে যে, রাতের বেলা সিঁদকেটে মানুষের মাথাকেটে নিয়ে যাচ্ছে। যাদের ঘরের ভিটিকাঁচা তাদের রাতের ঘুম হারাম হয়ে যায়। বাবা-মা তাদের ছোট বাচ্চাদের বিদ্যালয়ে পাঠানো বন্ধকরে দেয়। কিন্তু পরে পদ্মাসেতুর নকশায় কিছুটা পরীবর্তন এনে সেতুর কাজ পুরাদমে শুরু করা হয়। বর্তমনে পদ্মাসেতুর নির্মান কাজ প্রায় শেষ প্রান্তে।
২০২০ সালের প্রথম দিকে পিঁয়াজের দাম বৃদ্ধি পেলে গুজব ছড়িয়ে পড়ে যে, পিঁয়াজ পাওয়া যাবেনা। ভারত বাংলাদেশে পিঁয়াজ রপ্তানি করতে অপারগতা প্রকাশ করেছে। এতে করে একশ্রেনির মানুষ প্রয়োজনের অনেক বেশি পিঁয়াজ কিনে জমা করতে থাকে, ফলে ৩৫ টাকার পিঁয়াজ কোন কোন এলাকায় ২৮০ টাকা কেজী দরে বিক্র হয়। এসময় আরো একটি গুজব ছড়িয়ে পড়ে যে, বৃষ্টি ও বন্যার ফলে চট্টগ্রামের লবন উৎপাদন বন্ধ হয়ে গেছে, তাই লবন সংকট বেড়ে গেছে। এটি ফেসবুক নামক সামাজিক যেগাযোগ মাধ্যমে অতি দ্রুত দেশব্যপি ছড়িয়ে পড়লে একশ্রেনীর গুজব বিশ্বাসী মহিলা বিশেষত যাদের স্বামী বা সন্তান বিদেশে কর্মরত রয়েছে তারা লবন কিনে জমা করার জন্য হুমড়ি খেয়ে পড়ে। ফলে ৩৫ টাকা কেজীর লবনের দাম ১০০ টাকায় উঠে যায়। কিন্তু প্রশাসন ও আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী সংস্থার দ্রুত পদক্ষেপের ফলে তা একদিনেই আবার ৩৫ টাকায় নেমে আসে।
গত ১৯শে মার্চ অনুরূপ ভাবে গুজব ছড়িয়ে পড়ে যে, করোনা ভাইরাস সংক্রামনের মাত্রা ছড়িয়ে পড়ায় সরকার হাট-বাজার দেকান পাট সব বন্ধ করে দিবে। ফলে পরদিন অনুরূপ ভাবে ৪০ টাকা কেজীর পিঁয়াজ ৮০ টাকায়, চাল কেজীতে ৪, ৫ টাকা, মুড়ী কেজীতে ১০ টাকা বৃদ্ধি সহ, তেল, ডাল ও লবন সহ সবধরনের নিত্য প্রয়োজনীয় দ্রব্যের দাম অত্যাধিক বেড়ে যায়। কিন্তু প্রশাসন ও আইনশৃঙ্খলা রক্ষাবাহীনির দ্রুত পদক্ষেপের ফলে একদিনের মধ্যেই আগের দামে ফিরে আসে। তবে সুযোগ সন্ধানী ও গলির ভিতরের টং দোকানিরা এখনও অধিক দামে পণ্য বিক্রি করছে।
অতএব যারা গুজব ছড়ায় এবং যারা গুজব বিশ্বাস করে তারা মানুষ ও সমাজের শত্রু।