কাজী বিপ্লব হাসান : মাননীয় প্রধান মন্ত্রীর ঘোষনা অনুযায়ী তামাক মুক্ত বাংলাদেশ গড়ার লক্ষ্যে ধুমপান ও তামাকজাত দ্রব্য ব্যবহার নিয়ন্ত্রন আইন ২০০৫ ও ২০১৩ সালে সংশোধিত আইন অনুযায়ী আইন বাস্তবায়নে জেলা পর্যায়ে তামাক মুক্ত সমাজ গড়ার লক্ষ্যে “কর্মশালা” অনুষ্ঠিত হয়েছে। জেলা সিভিল সার্জন অফিসের কনফারেন্স রুমে আজ ১৬ মে ২০২৪ সকাল ১০:৩০ মিনিটে লাইফ স্টাইল, হেল্থ এডুকেশন এন্ড প্রমোশন, স্বাস্থ্য শিক্ষা ব্যুরো, স্বাস্থ্য অধিদপ্তর, স্বাস্থ্য সেবা বিভাগ, স্বাস্থ্য ও পরিবার কল্যান মন্ত্রনালয়ের আয়োজনে এবং জেলা সিভিল সার্জন অফিসের বাস্তবায়নে উক্ত কর্মশালা অনুষ্ঠিত হয়। জেলা সিভিল সার্জন অফিসের মেডিকেল অফিসার ড. মল্লিকা সরকারের সভাপতিত্বে উক্ত কর্মশালায় উপস্থিত ছিলেন সিভিল সার্জন অফিসের মেডিকেল অফিসার ড. জসিম উদ্দিন ভুইয়া, সিনিয়ার স্বাস্থ্য শিক্ষা অফিসার নাসির উদ্দিন, জেলা স্যানেটারি ইন্সপেক্টর গাজী মোঃ আমিন। জন প্রতিনিধি হিসেবে উপস্থিত ছিলেন মুন্সীগঞ্জ পৌরসভার ৬নং ওয়ার্ড কাউন্সিলর সাত্তার মুন্সী, ৭নং ওয়ার্ড কাউন্সিলর তুষার আহমেদ, ৮নং ওয়ার্ড কাউন্সিলর আওলাদ হোসেন, মহিলা কাউন্সিলর পারভীন আক্তার ও রুমা বেগম। এছাড়া কর্মশালায় জেলার বিভিন্ন স্কুলের শিক্ষকগণ ও বিভিন্ন মসজিদের ঈমামগণ এবং জেলার স্বাস্থ্য কর্মগণ উপস্থিত ছিলেন। তামাকের ভয়াবহতা সম্পর্কে আলোচনা করা হয়। বলা হয়, তামাক নিয়ন্ত্রন জরুরি কারণ তামাকের ধোয়ায় ৭০০০ এর বেশি ক্ষতিকর রাসায়নিক রয়েছে যা শরীরের প্রতিটি অঙ্গ-প্রত্যঙ্গের ক্ষতিকরে। পৃথিবীতে প্রতিবছর ৮০ লক্ষ লোক মারা যায় তামাক সেবনে। বাংলাদেশের জন সংখ্যার ১ লক্ষ ৬১ হাজারের অধিক লোক মারা যায় তামাক ব্যবহারের কারনে। কর্মশালায় আরো বলা হয়, শিক্ষা প্রতিষ্ঠান সহ পাবলিক প্লেসে ও পাবলিক পরিবহনে ধুমপান বন্ধ করতে হবে। এতে ধুমপান করলে ৩০০ টাকা জরিমানা করা হবে। তামাকজাত দ্রব্যের কোনো প্রকার বিজ্ঞাপন প্রচার করা যাবে না। সভাপতি ড. মল্লিকা সরকার বলেন, স্বাস্থ্য কর্মী, ঈমাম, শিক্ষক, জন প্রতিনিধি আপনাদের প্রত্যেক কেই এই নিয়ম অনুযায়ী চলতে হবে। এবং তামাক জাত দ্রব্য সমর্কে যে সকল নিষেধাজ্ঞা রয়েছে তা আপনাদের আশ-পাশের সকলকে জানিয়ে দিবেন, তামাকের ভয়াবহতা সম্পর্কে বুঝিয়ে দিবেন। সভাপতির ভাষনের মাধ্যমে কর্মশালার পরিসমাপ্তি ঘটে।
বিশ্বব্যাপী প্রতিরোধযোগ্য মৃত্যুর অন্যতম প্রধান কারণ তামাক পণ্যের ব্যবহার। তামাকের মধ্যে সাত হাজার রাসায়নিক চিহ্নিত করা গেছে। এর মধ্যে প্রায় ২৫০ ধরনের রাসায়নিক পদার্থ মানবদেহের জন্য ক্ষতিকরÑ যেগুলো ধূমপায়ী ও অধূমপায়ীদের মারাত্মক রোগ সৃষ্টি করে এবং মৃত্যু ঘটায়। এসব রাসায়নিকের মধ্যে নিকোটিন অন্যতম যেটি মারাত্মক নেশা সৃষ্টিকারী।
বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার (ডব্লিউএইচও) মতে, তামাকজাত পণ্য ব্যবহারের কারণে প্রতিবছর বিশ্বে ৮০ লাখের বেশি মানুষের প্রাণহানি ঘটছে। তাদের বেশিরভাগই সরাসরি তামাক ব্যবহার করেন। ২০১৭ সালের গ্লোবাল অ্যাডাল্ট টোব্যাকো সার্ভেতে দেখা গেছে, বাংলাদেশে ৩৫ দশমিক ৩ শতাংশ প্রাপ্তবয়স্ক (বয়স ১৫ বছর বা ততোধিক) মানুষ (প্রায় ৩ কোটি ৭৮ লাখ) তামাক ব্যবহার করে (১৮ শতাংশ ধূমপান করে এবং ২০ দশমিক ৬ শতাংশ ধোঁয়াবিহিন তামাক ব্যবহার করে)। বাংলাদেশে অপ্রাপ্তবয়স্কদের মধ্যেও তামাক ব্যবহারের হার আশঙ্কাজনক। ২০১৩ সালে পরিচালিত এক জরিপে দেখা গেছে, ১৩ থেকে ১৫ বছর বয়সী ছেলেমেয়ের মধ্যে প্রায় ৭ শতাংশ কোনো না কোনো ধরনের তামাক ব্যবহার করে।
অন্যদিকে নিজে ধূমপায়ী না হয়েও আশপাশের ধূমপায়ীর ধোঁয়া গ্রহণ করে পরোক্ষভাবে ধূমপানের শিকার হচ্ছেন নারী ও শিশুসহ অধূমপায়ীরা। পরোক্ষ ধূমপানও সরাসরি ধূমপানের মতো প্রায় সমান ক্ষতিকর। বাংলাদেশে বিভিন্ন পাবলিক প্লেস ও পাবলিক পরিবহনে প্রতিদিন প্রায় ৩ কোটি ৮৪ লাখ প্রাপ্তবয়স্ক মানুষ পরোক্ষ ধূপমানের শিকার হন (প্রাপ্তবয়স্কদের ৪২ দশমিক ৭ শতাংশ আচ্ছাদিত কর্মক্ষেত্রে, ৪৯ দশমিক ৭ শতাংশ রেস্তোঁরায় ও ৪৪ শতাংশ গণপরিবহনে পরোক্ষ ধূমপানের শিকার হন)। এর পাশাপাশি অপ্রাপ্তবয়স্কদের (১৩-১৫ বছর) ৫৯ শতাংশ পাবলিক প্লেসে পরোক্ষ ধূমপানের শিকার হয়। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার মতে, প্রতিবছর ১২ লাখ মানুষ সরাসরি ধূমপান না করে শুধু ধূমপায়ীদের সংস্পর্শে থাকার কারণে প্রাণ হারাচ্ছে।
তামাক এমন একটি পণ্য- যাতে আসক্ত হলে মানব শরীরের প্রতিটি অঙ্গ-প্রত্যঙ্গ রোগাক্রান্ত হতে পারে। আজকের বিশ্বে সংক্রামক রোগের তুলনায় অসংক্রামক ও প্রতিরোধযোগ্য রোগের প্রকোপ অনেক বেশি এবং মারাত্মক স্বাস্থ্য সমস্যা হিসেবে দেখা দিয়েছে। বাংলাদেশও এর ব্যতিক্রম নয়। বাংলাদেশে সংক্রামক রোগগুলো অনেকাংশেই নিয়ন্ত্রণে এলেও অসংক্রামক রোগ যেমন হৃদরোগ, ডায়াবেটিস, দীর্ঘমেয়াদি শ্বাসরোগ, ক্যানসার, কিডনি রোগ ও আঘাতজনিত রোগ ক্রমেই বাড়ছে। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার ২০২২ সালের এক পরিসংখ্যান অনুযায়ী বাংলাদেশে বর্তমানে মোট মৃত্যুর শতকরা ৭০ ভাগই ঘটছে অসংক্রামক রোগের জন্য। এর মধ্যে ৩৪ ভাগ হৃদরোগ, ১৪ ভাগ ক্যানসার, ৭ ভাগ ফুসফুসের রোগ, ৪ ভাগ ডায়াবেটিস ও ৭ ভাগ এককভাবে আঘাতজনিত রোগ রয়েছে। একই সঙ্গে ১১ ভাগ মানুষ মৃত্যুবরণ করে অন্যান্য অসংক্রামক রোগে। অসংক্রামক রোগগুলোর অন্যতম প্রধান কারণ তামাকজাত দ্রব্যের ব্যবহার।
বাংলাদেশে তামাক ব্যবহারের ফলে প্রতিবছর প্রায় ১ লাখ ৬১ হাজার মানুষ অকালে মৃত্যুবরণ করে (দৈনিক প্রায় ৪৪২ জন, সূত্র : ডব্লিউএইচও টোবাকো এটলাস)। উল্লেখ্য, পরোক্ষ ধূমপানে শিশুদের হাঁপানির ঝুঁকি বাড়ে। এ ছাড়া হঠাৎ মৃত্যু ঘটতে পারে। ধূমপান নারীদের ক্ষেত্রে গর্ভপাত ঘটার হার বেশি। শুধু তা-ই নয়, প্রতক্ষ ও পরোক্ষ ধূমপায়ী নারীদের ক্ষেত্রে গর্ভস্থ ভ্রƒণের ক্ষতি করে। যেমনÑ অকাল শিশুর জন্ম হওয়া, জন্মের সময় নবজাতকের ওজন আদর্শ ওজনের চেয়ে কম হওয়া ও সাডেন ইনফ্যান্ট ডেথ সিনড্রমের (এসআইডিএস) হার ১ দশমিক ৩ থেকে ৪ শতাংশ বেড়ে যায় এবং গর্ভবর্তীর গর্ভপাত হওয়া ও অতিরিক্ত রক্তক্ষরণ ঘটার আশঙ্কাও থাকে। আরও বলতে চাইÑ তামাক থেকে যে রাজস্ব আয় আসে, এর চেয়ে তামাক ব্যবহারজনিত কারণে বিভিন্ন রোগে আক্রান্ত হয়ে চিকিৎসা বাবদ ব্যয় ২৭ শতাংশ বেশি। এর মধ্যে রাজস্ব আয় প্রায় ২২ হাজার কোটি টাকা এবং চিকিৎসা ব্যয় প্রায় ৩০ হাজার কোটি টাকা (ক্যানসার সার্ভে ২০১৮)। আরও একটি বিষয় বলা প্রয়োজন। তা হলোÑ বাংলাদেশে প্রতিবছর যে পরিমাণ বন ধ্বংস হচ্ছে, এর ৩০ শতাংশ ধ্বংস হয় তামাক শুকানোর কাজে গাছ কাটার কারণে।
যেহেতু তামাক ব্যবহারকারীদের প্রায় অর্ধেকই অকাল মৃত্যুবরণ করে, সেহেতু ওই সংখ্যা পূরণের লক্ষ্যে তামাক কোম্পানিগুলো টার্গেট করে তরুণ ও যুবকদের। আর এই বয়সী জনগোষ্ঠীকে একবার তামাকে আসক্ত করতে পারলে তাদের সারাজীবনের ভোক্তা পেয়ে যাবে। তাই এ জনগোষ্ঠীকে টার্গেট করে তারা বিভিন্ন কূটকৌশলের আশ্রয় নেয়। এ লক্ষ্যে তারা ব্যবসায়ীদের বিভিন্নভাবে প্রণোদনা দিয়ে শিক্ষা প্রতিষ্ঠান, খেলার মাঠের আশপাশে অসংখ্য তামাকপণ্য বিক্রির দোকান স্থাপন করে যাতে এ কোমলমতি শিশু-কিশোররা খুব সহজেই হাত বাড়িয়ে দিয়ে এসব পণ্য কিনতে পারে। এক গবেষণায় দেখা গেছে, বাংলাদেশের প্রায় ৯০ শতাংশ স্কুল ও খেলার মাঠের ১০০ মিটারের মধ্যে তামাক পণ্য বিক্রির দোকান রয়েছে। ফলে কোমলমতি শিশু-কিশোররা খুব সহজেই হাতের কাছে এসব ক্ষতিকর পণ্য পাচ্ছে ও আসক্ত হচ্ছে।
উল্লিখিত তথ্য উপস্থাপনের লক্ষ্য হচ্ছে পাঠককে তামাকজনিত পণ্য ব্যবহারের ক্ষতি সম্পর্কে খুব সহজেই জানানো ও উপলব্ধি করানো। তামাক ব্যবহার আমাদের মতো উন্নয়নশীল দেশে জনস্বাস্থ্যের জন্য খুবই উদ্বেগের বিষয়। তা শুধু ধূমপায়ীদের নয়, তাদের পরিবার ও সমাজকেও প্রভাবিত করে। তাই তামাকমুক্ত দেশ গড়তে রাষ্ট্র ও সমাজের একসঙ্গে কাজ করা অপরিহার্য। এ জন্য প্রয়োজন জনস্বাস্থ্যকে উন্নত এবং তামাকের ক্ষতিকর প্রভাব থেকে নাগরিকদের রক্ষা করেÑ এমন শক্তিশালী আইন প্রণয়ন ও এর যথাযথ বাস্তবায়ন। এ ক্ষেত্রে সংশোধিত তামাক নিয়ন্ত্রণ আইন ২০২৩ দ্রুত পাস ও তা যথাযথভাবে প্রয়োগ করতে হবে। শক্তিশালী তামাক নিয়ন্ত্রণ আইন যে কোনো দেশের তামাক নিয়ন্ত্রণের জন্য অপরিহার্য। আইন থাকলে জনগণ তাদের অধিকার আদায়ে সচেষ্ট থাকতে পারে। সরকারের বিভিন্ন প্রতিষ্ঠান ও জনগণ মিলে তামাক নিয়ন্ত্রণ আইনগুলো যথাযথভাবে বাস্তবায়নের মাধ্যমে দেশে তামাকের ব্যবহার হ্রাসে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখতে সহায়ক হবে।
একটি কথা মনে রাখতে হবে, তামাকমুক্ত দেশ গড়ার দায়িত্ব শুধু রাষ্ট্রের নয়। তামাকের ছোবল থেকে রাষ্ট্র ও সমাজকে রক্ষা করতে দরকার সামাজিক আন্দোলন। ভবিষ্যৎ প্রজন্মকে তামাকের ভয়াল থাবা থেকে রক্ষায় সমাজের সবস্তর প্রতিনিধির সমন্বয়ে বিভিন্ন ফোরামের মাধ্যমে তামাকের ক্ষতিকর দিকগুলো আলোচনায় আনতে হবেÑ যাতে তরুণদের রক্ষার্থে অভিভাবকরা সচেতন হতে ও যথাযথ পদক্ষেপ নিতে পারেন।
সুস্থ-সবল জাতি গঠন ও স্মার্ট বাংলাদেশ বিনির্মাণে তামাকমুক্ত বাংলাদেশ গড়া অপরিহার্য। এসডিজি লক্ষমাত্রা-৩ (স্বাস্থ্য ও কল্যাণ) অর্জনে তামাক নিয়ন্ত্রণ খুবই জরুরি। ইতোমধ্যে প্রধানমন্ত্রী ২০৪০ সালের মধ্যে বাংলাদেশকে তামাকমুক্ত করার প্রত্যয় ব্যক্ত করেছেন। এখন প্রয়োজন রাষ্ট্র ও সমাজÑ উভয়ের সমন্বিত প্রচেষ্টা। রাষ্ট্রকে অবশ্যই জনস্বাস্থ্যের উন্নতির জন্য নীতি তৈরিতে নেতৃত্ব ও সমর্থন প্রদান করতে হবে। অন্যদিকে সমাজকেও স্বাস্থ্যকর আচরণ অভ্যাস গঠনে প্রচার করতে হবে; যারা ধূমপান ত্যাগ করতে চান, তাদের জন্য সহায়তা প্রদান করতে হবে। একসঙ্গে কাজ করার মাধ্যমে আমরা আমাদের জাতির জন্য একটি স্বাস্থ্যকর ও আরও সমৃদ্ধ ভবিষ্যৎ গড়ে তুলতে পারি।