সুদিনে ফিরছে ‘পাট’

স্টাফ রিপোর্টার : দেশ ছাড়িয়ে বিদেশেও সুনাম ছিল সোনালী আঁশ খ্যাত পাটের। পাটের নাম আসলেই আদমজী জুট মিলের নাম আসতো। পাট দিয়ে তৈরি হতো কাপড়, শতরঞ্জি, পাপোশ, ব্যাগ, বস্তা, বিভিন্ন জিনিসপত্র। বিশেষ করে নারীদের সূক্ষ্ম হাতের নিপুণ ছোঁয়ায় মনের মাধুরী মিশিয়ে তৈরি করা জিনিসগুলো নজর কাড়ত যে কারো।

একটা সময় দেশব্যাপী সাড়া পাওয়ায় পাটের ব্যাপক চাহিদায় ভাগ্য বদলায় এই অঞ্চলের কৃষকদের। তবে বাজারে পলিথিনের আগমনে তখন থেকেই পাটের জগতে নেমে আসে অন্ধকার। এতে ন্যায্য দাম না পাওয়ায় কমতে থাকে চাষ ও পাট চাষির সংখ্যা। পলিথিনের ব্যবহার বন্ধে আবারো ফিরতে পারে সোনালি আঁশের সুদিন, এমনটি মনে করছেন পাট চাষিরা। পাটের সুদিন ফিরছে এমনটা জানালেন বাংলাদেশ জুট অ্যাসোসিয়েশনের (বিজেএ) চেয়ারম্যান ফরহাদ আহমেদ আকন্দ ।

বিজেএ নিজস্ব কার্যালয়ে সম্প্রতি অনুষ্ঠিত ৫৭তম বার্ষিক সাধারণ সভায় তিনি বলেন, পাট রফতানি খাতে বাংলাদেশের এখনও উজ্জ্বল সম্ভাবনা রয়েছে। গত অর্থ বছরে আমরা সাড়ে ১৪শ’ কোটি টাকার ১৩ লাখ বেল পাট বিদেশে রফতানি করেছি। সরকার সহযোগিতা করলে আগামীতেও আমরা রফতানির পরিমাণ বাড়াতে চাই।

জানা গেছে, সম্প্রতি পলিথিনমুক্ত দেশ গড়ার ঘোষণা চাষিদের মধ্যে নতুন স্বপ্ন জাগিয়েছে। এই সিদ্ধান্তে আবারও সুদিন ফেরাতে খুশি পাট চাষিরা। পরিবেশের জন্য ক্ষতিকর পলিথিনের ব্যবহার কমলে পাট পণ্যের ব্যাপক চাহিদা বাড়বে। এতে করে অতীতের ন্যায় আবারও ন্যায্যমূল্য পাবেন কৃষকরা। পলিথিন ব্যবহার বন্ধে কঠোরতায় বিভিন্ন উদ্যোক্তা ও শহরের ছোট-বড় দোকানগুলোতে নজর কাড়ছে কাপড় কিংবা কাগজের ব্যাগ ব্যবহার করতে বাধ্য হচ্ছেন ক্রেতারা। গত পহেলা অক্টোবর থেকে সুপারশপগুলোতে পলিথিন ব্যাগ ব্যবহার নিষিদ্ধ করা হয়।

জানা গেছে, পাটশিল্প ব্রিটিশ ও পাকিস্তানি আমলে দেশের একক বৃহত্তম শিল্প ছিল। এদেশে পাটশিল্পের সূচনা ঘটে নারায়ণগঞ্জের শীতলক্ষ্যা নদীর তীরে এবং পরবর্তী সময়ে অন্যান্য প্রতিষ্ঠানও এর আশপাশেই গড়ে ওঠে। ঢাকা, খুলনা ও চট্টগ্রাম-প্রধানত এ তিনটি অঞ্চলে ছড়িয়ে আছে এদেশের পাটকলগুলো।

বিশ্ববাজারে পাটের সামগ্রীর চাহিদা থাকলেও পাটকলগুলো বন্ধ থাকায় বাংলাদেশে পাটচাষ দিন দিন কমে যাচ্ছে। এতে করে পাটশিল্পে ধস নামতে শুরু করেছে। ফলে বিপাকে পড়েছেন পাট শ্রমিকরা। অধিকাংশ শ্রমিক চাকরি হারিয়ে বেকার হয়ে পড়েছেন। অথচ সোনালি আঁশখ্যাত পাটের এ বেহাল দশা হওয়ার কথাই ছিল না।

বাংলাদেশ জুট অ্যাসোসিয়েশনের (বিজেএ) চেয়ারম্যান ফরহাদ আহমেদ আকন্দ বলেন, বাংলাদেশ জুট অ্যাসোসিয়েশন দেশের সবচেয়ে প্রাচীন রফতানিকারক সংগঠন। আমরা কাঁচা পাট বিদেশে রফতানি করে থাকি। যার মাধ্যমে বাংলাদেশ প্রচুর পরিমাণ বৈদেশিক মুদ্রা অর্জন করছে। অতীতে বিভিন্ন সময় সরকারের কিছু ভুল সিদ্ধান্তের কারণে আমরা পাট রফতানিকারক ব্যবসায়ীরা আর্থিকভাবে ব্যাপক ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছি। সেই ক্ষতি মেনে নিয়ে লোকসান দিয়েই আমরা দেশের স্বার্থে পাট রফতানি অব্যাহত রেখেছি। ফলে বাংলাদেশ প্রচুর পরিমাণ বৈদেশিক মুদ্রা অর্জন করে অর্থনৈতিক অবস্থার উন্নতি হয়েছে।

তিনি বলেন, এ সমস্যাগুলোর বিষয়ে আমরা ইতোমধ্যে বর্তমান অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের কাছে বেশ কিছু দাবি উত্থাপন করেছি এবং এ নিয়ে সংশ্লিষ্ট মন্ত্রণালয়ে আলোচনাও চলছে। সরকার আমাদের সমস্যাগুলো সমাধানের ব্যবস্থা করলে পাট রফতানি খাত আরও গতিশীল হবে এবং দেশের অর্থনীতির অবস্থারও উন্নতি হবে বলেও আমরা মনে করি।

জানা গেছে, পাট একটি পচনশীল বস্তু। পাট থেকে বিভিন্ন সুতা, হস্তশিল্প, ব্যাগ, দড়ি, পাত্র ইত্যাদি তৈরি করা হতো। অতীতে পাটের তৈরি বিভিন্ন জিনিস রপ্তানি করা হতো বিদেশে। একসময় পাটের তৈরি জিনিসের চাহিদা ছিল ব্যাপক। আর কৃষকরা ভালো দাম পওয়ায় পাট চাষ করতেন হাসিমুখে। পাট ও পাটজাত দ্রব্য একসময় ছিল দেশের প্রধান রপ্তানিপণ্য। এ শিল্পের জন্য আলাদা মন্ত্রণালয়ও আছে।

পাট ব্যবসায়িরা জানান, সরকারের উচিত পাটশিল্পকে পুনরুজ্জীবিত করতে বিভিন্ন পদক্ষেপ নেওয়া। পাটকলগুলো চালু করা। পাট চাষে কৃষকদের উদ্বুদ্ধ করা। বাজারে কৃষকরা যাতে ন্যায্য দাম পায়, সে ব্যবস্থা করা। দেশেও পাটের তৈরি বিভিন্ন জিনিস বাজারজাত করার ব্যবস্থা করা। পলিথিনের পরিবর্তে পাটের তৈরি পলিজুট ব্যাগ ব্যবহার করা। এছাড়াও প্লাস্টিকের ব্যবহার কমিয়ে পাটের তৈরি বিভিন্ন জিনিসের ব্যবহার বাড়ানো। পাটের বাজার আবারও যাতে সম্প্রসারিত হয়, সেজন্য কার্যকর উদ্যোগ নেওয়া এবং বাইরের দেশের সঙ্গে যোগাযোগ বাড়িয়ে পাটের পণ্য রপ্তানির ব্যবস্থা জোরদার করা।

এদিকে মধ্যপ্রাচ্য, ইউরোপসহ বিশ্বের বিভিন্ন দেশের দূতাবাসগুলোতে পাটপণ্যের প্রদর্শনী কর্নার করার নির্দেশনা দিয়েছেন বস্ত্র ও পাট মন্ত্রণালয়।

মন্ত্রণালয়ের সূত্রে জানা গেছে এখন শুধু দেশে নয়, বিদেশেও পাটপণ্যের যথেষ্ট চাহিদা আছে। পরিবেশ দূষণরোধে বিশ্বব্যাপী সচেতনতার কারণে পাট ও পাটজাত পণ্যের চাহিদা বেড়েছে। দুবাই, সুইজারল্যান্ডসহ বিভিন্ন দেশ পাটপণ্য ব্যবহার ও আমদানিতে আগ্রহ জানিয়েছে। বর্তমান সরকার পলিথিনের বদলে পাটের ব্যাগ চালুর উদ্যোগে দেশের অভ্যন্তরে পাটের চাহিদা বৃদ্ধি পাচ্ছে।

সূত্র জানায়, দেশে প্রায় ছয় হাজার মেট্রিক টন পাট বীজের চাহিদা রয়েছে। সেখানে প্রায় একহাজার ৫০০ মেট্রিক টন বীজ দেশে উৎপাদিত হচ্ছে। পরিকল্পনা ও প্রকল্পের মাধ্যমে পাটের বীজ উৎপাদন বাড়াতে হবে এবং পাট থেকে তৈরি সুতারও উৎপাদন বাড়াতে হবে।

গত মাসের মাঝামাঝি থেকে নিজের কারখানার ১০ মেশিন নিয়ে ব্যস্ত আকলিমা বেগম। সব সুপারশপে পলিথিন ও পলিপ্রোপিলিন শপিং ব্যাগ নিষিদ্ধে সরকারের সিদ্ধান্তের কারণে তার এই ব্যস্ততা। সুরজু হ্যান্ডিক্রাফটস হাতে গোনা কয়েকজন ক্রেতার জন্য পাট-কাপড় দিয়ে পরিবেশবান্ধব, হালকা ও পুনর্ব্যবহারযোগ্য বাজারের ব্যাগ তৈরি করে আসছিল। তবে তা নিয়মিত ছিল না। প্রয়োজন ক্রেতার। এরপর থেকে সুপারমার্কেটগুলোয় ২০ হাজারের বেশি ব্যাগ সরবরাহ করেছে সুরজু হ্যান্ডিক্রাফটস। বর্তমানে সুপারশপগুলো থেকে আরও ৩২ হাজার ব্যাগের অর্ডার পেয়েছেন তিনি।

পরিবেশবান্ধব ব্যাগ তৈরির আরেক প্রতিষ্ঠান বেকি সেন্টারের মালিক তাহমিদুল ইসলাম জানান, অন্তর্বর্তী সরকার সুপারমার্কেটে পচনশীল ব্যাগ ব্যবহার করতে বলার আগে তারা প্রচারণামূলক পণ্য তৈরি করতেন। তিনি বলেন, ‘নিষেধাজ্ঞা কার্যকর হওয়ার পর থেকে সুপারস্টোরগুলোয় আমরা ৩০ হাজারেরও বেশি ব্যাগ সরবরাহ করছি।’

জুট ডাইভারসিফায়েড প্রোডাক্টস ম্যানুফ্যাকচারার্স অ্যান্ড এক্সপোর্টার্স অ্যাসোসিয়েশনের সভাপতি রাশেদুল করিম মুন্না বলেন, ‘পাটের ব্যাগের প্রতি মানুষের ব্যাপক আগ্রহ আছে। ‘কম দামের ব্যাগের জন্য কাপড় তৈরির প্রস্তুতি ছিল না কারখানাগুলোর। এ ধরনের ব্যাগ তৈরিতে আলাদা উপকরণ লাগে। উদ্যোক্তাদের আলাদাভাবে বিনিয়োগ করতে হয়। তিনি মনে করেন, পরিবেশবান্ধব বাজারের ব্যাগ ব্যবহার বাধ্যতামূলক করার বিষয়ে সরকারের নিশ্চয়তা প্রয়োজন। ‘সরকারের উচিত এমন প্রজ্ঞাপন জারি করা যাতে বলা হবে, এই নিষেধাজ্ঞা কমপক্ষে তিন বছর কার্যকর থাকবে। তাহলে পাটের দেশে বড় বাজার তৈরি হবে। অনেকে কাজের সুযোগ পাবেন।’

পরিবেশ, বন ও জলবায়ু পরিবর্তন উপদেষ্টা সৈয়দা রিজওয়ানা হাসান বলেছেন, বিকল্প হিসেবে সব সুপারশপে বা শপের সামনে পাট ও কাপড়ের ব্যাগ ক্রেতাদের জন্য রাখা হবে। গত ১ অক্টোবর থেকে সুপারশপে কোনো ধরনের পলিথিন বা পলিপ্রপিলিনের ব্যাগ রাখা যাবে না এবং ক্রেতাদের দেওয়া যাবে না বলে নির্দেশনা দিয়েছেন তিনি।

বস্ত্র ও পাট মন্ত্রণালয়ের উপদেষ্টা শেখ বশির উদ্দিন বৃহস্পতিবার বলেছেন, পাটকে আবেগ দিয়ে বাঁচানো যাবে না। পাটের আবেগ দিয়ে আমরা স্বাধীনতা এনেছি। কিন্তু স্বাধীনতা পরবর্তী আবেগ দিয়ে সেই পাটকে বাঁচানো যায়নি। স্বাধীনতা পরবর্তী পাট আমাদের প্রথম অর্থনৈতিক শহীদ। কিছু ব্যবসায়ী পাট মজুত করে কৃত্রিম সংকট তৈরি করার চেষ্টা করছে। বাজার স্বাভাবিক রাখতে আমরা তাদের বিরুদ্ধে কঠোর ব্যবস্থা গ্রহণ করবো। তিনি বলেন, পাটকে বাঁচাতে হলে এর ব্যবহারিক মূল্য ও ব্যবহারিক উপযোগিতার সৃষ্টি করতে হবে। শৈল্পিক মূল্য দিয়ে পাটকে বাঁচানো যাবে না। পাটকে বাঁচাতে হলে ব্যবহারিক স্কেল-আপ করতে হবে। বলা হচ্ছে, তৈরি পোশাক শিল্পকে সরকারের পক্ষ থেকে প্রণোদনা-নীতির সহায়তা দেওয়া হয়, ব্যাংকঋণ দেওয়া হয়। কিন্তু শুরুতে এমনটা ছিল না। শুরুতে তৈরি পোশাক শিল্পকেও ব্যাংক ঋণ দিত না। সংগ্রাম

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *