শব্দ দূষণে অতিষ্ট মুন্সীগঞ্জবাসী

কাজী বিপ্লব হাসান: ক্ষতিকর পদার্থ পরিবেশের উপাদানসমূহে যুক্ত হলেই তা হলো পরিবেশ দূষণ। পরিবেশের ভৌত, রাসায়নিক ও জৈবিক বৈশিষ্ট্যের অবাঞ্চিত পরিবর্তন কোন জীবের জীবনধারনকে ক্ষতিগ্রস্ত করে তোলে বলেই তাকে পরিবেশ দূষণ বলে। পরিবেশ দূষনের মধ্যে বায়ু দূষণ, মাটি দূষণ, জল দূষণ ও শব্দ দূষণ প্রধান। এর মধ্যে শব্দ দূষণ এখন জনজীবনের জন্য জীবন বিনাশী সন্ত্রাসে পরিণত হয়েছে। রাজধানী ঢাকাসহ পুরো দেশ জুড়েই শব্দ দূষণ এক নিরব ঘাতকে পরিণত হয়েছে। বিজ্ঞানীদের গবেষনায় উঠে এসেছে, আগামী ৫ বছরের মধ্যে রাজধানীসহ আশপাশের এলাকায় এক তৃতীয়াংশ লোক কানে কম শুনবে। শব্দ দূষণের নিয়ন্ত্রনের জন্য আইন আছে, কিন্তু তার প্রয়োগ নেই এর বিরুদ্ধে। প্রথমেই যানবাহনের কথা বলি। ইদানিং যানবাহনের সংখ্যা রাজধানীতে তো বেড়েছেই। এর পাশের শহর মুন্সীগঞ্জেও ক্রমান্বয়ে অটোবাইক, মিশুক ও সিএনজির সংখ্যা বাড়ছে। এতে যানবাহনের হর্নের সংখ্যাও বাড়ছে। যেখানে হর্ন বাজানো উচিত নয়। অনেক চালকই অদক্ষতার কারণে তা না জেনে অফিস-আদালত, শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান ও হাসপাতালের মতো চিকিৎসালয়ের সামনেও অনবরত হর্ন বাজিয়ে যাচ্ছে। এটা শব্দ দূষণের একটি মূল কারণ। রাস্তাঘাটে জনগন যখন যাতায়াত করে, তখন বাধ্য হয়ে তাদের কানে হাত দিয়ে নতুবা কানে এক ধরনের যন্ত্র ফিটিং করে যায়। যাতে শব্দ কানে কম শোনা যায়। মুন্সীগঞ্জ শহরের মুক্তারপুর এলাকা, জেলা কোর্ট এলাকা, মুন্সীগঞ্জ পৌরসভা চৌরাস্তা এলাকা, সদর বাজার এলাকা এই শব্দ দূষণের আওতায় অধিক পরিমানে আছে। অন্য ৫টি উপজেলায়ও বাসস্ট্যান্ড এলাকা, সিএনজি এলাকা ও বড় বড় বাজার ও মার্কেট সংলগ্ন এলাকাগুলো এই শব্দ দূষণের অতিরঞ্জন এলাকার মধ্যে পড়ে। যানবাহনের পরে আসে সামাজিক অনুষ্ঠানের কথা। এখানে শুধু মুন্সীগঞ্জ নয় পুরো দেশ জুড়ে বলতে হয় বিয়ে বা গায়ে হলুদ এর অনুষ্ঠানসহ নানা ধরনের সামাজিক-রাজনৈতিক অনুষ্ঠানে উচ্চ শব্দে মাইকে গান বাজানো একটা স্বাভাবিক ঘটনায় পরিণত হয়েছে।

আর রাজনৈতিক দলগুলো তাদের নেতাদের জন্মবার্ষিকী, মৃত্যুবার্ষিকী বা বিশেষ দিনগুলোতে সারা রাত ধরে উচ্চ শব্দে মাইক বাজালেও কেউ তার প্রতিবাদ করার সাহস পায়না। অথচ এটি একটি সামাজিক অনাচার। বাংলাদেশ পরিবেশ সংরক্ষন আইন ১৯৯৫-এর ক্ষমতাবলে শব্দ দূষণ নিয়ন্ত্রন বিধিমালা-২০০৬ প্রনয়ন করা হয়। বিধিমালার আওতায় নীরব, আবাসিক, মিশ্র, বাণিজ্যিক ও শিল্প এলাকা চিহ্নিত করে শব্দের নির্র্দিষ্ট মান মাত্রা নির্ধারন করে দেয়া হয়েছে। এই আইন অমান্য করলে প্রথম বার অপরাধের জন্য এক মাস কারাদন্ড বা অনাধিক ৫ হাজার টাকা অর্থদন্ড অথবা উভয়দন্ড এবং পরবর্তী অপরাধের জন্য ৬ মাস কারাদন্ড বা অনাধিক ১০ হাজার টাকা অর্থদন্ড বা উভয়দন্ডে দন্ডিত হওয়ার বিধান রয়েছে। কিন্তু বাস্তবে এই আইনের প্রয়োগ তেমন হচ্ছে না।

বাংলাদেশ পরিবেশ বাঁচাও আন্দোলন (বাপা) এর সাধারন সম্পাদক ডা. আব্দুল মতিন বলেন, পরিবেশবাদীদের শত চেষ্টা এবং প্ররোচনায় কোন কাজে আসবে না, যদি না সরকারের স্বদিচ্ছা থাকে। তিনি জানান, দেশে আইন আছে, তবে এর ব্যবহার নেই। তাহলে আইন তৈরি করা কিসের জন্য? সরকার যদি চায় অবশ্যই জনগনকে মোটিভেট করতে পারে। আমরা আন্দোলন করি শুধু সরকারের কানে পৌঁছানোর জন্য। বিশ্বের অন্যান্য দেশে সম্ভব হলে, এদেশে কেন হবে না? শুধুমাত্র উদ্যোগটা দরকার। আর এটা সরকার ছাড়া কারো পক্ষে সম্ভব নয়। বেসরকারি সংস্থা ওয়ার্ক ফর এ বেটার বাংলাদেশ (ডইই) ট্রাস্ট সম্প্রতি জানান, নির্ধারিত মানদন্ডের চেয়ে গড়ে প্রায় দেড়গুন বেশি শব্দ সৃষ্টি হয় এ দেশে।

সাধারনভাবে মুন্সীগঞ্জে যানবাহগন ও হর্নের শব্দই শব্দ দূষণের একটি বিশেষ কারণ। তাছাড়া মুন্সীগঞ্জ শহরে রাজনৈতিক-সামাজিক অনুষ্ঠানে উচ্চ শব্দে মাইক বা সাউন্ড সিস্টেম ব্যবহার আরও একটি শব্দ দূষণের বড় কারণ। যদি আমরা ইনডোর শব্দ দূষণের দিকটি বিবেচনায় নেই তাহলে টাইলস লাগানো, মিউজিক সিস্টেমে জোরে গান বাজানো, ড্রিলিং এগুলোর শব্দ রয়েছে।

ডাক্তারী মতে উচ্চ মাত্রায় শব্দের কারণে মানুষের শ্রবণশক্তি ক্রমান্বয়ে হ্রাস, বধিরতা, হৃদরোগ, মেজাজ খিটখিটে হওয়া, আলসার, বিরক্তি প্রভৃতি রোগের সৃষ্টি হয়। এতে সবচেয়ে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে শিশু ও বয়স্করা। এমনকি মাতৃগর্ভে থাকা সন্তানও শব্দ দূষণে ক্ষতির স্বীকার হয় অর্থাৎ তাদের শ্রবণ শক্তি খুব দ্রæত নষ্ট হয়ে যায়। মুক্তারপুর বাণিজ্যিক এলাকায় কারখানা সংলগ্ন এলাকার বাসিন্দারা ও তাদের সন্তানগন এ রোগে বেশি আক্তান্ত হন।

শব্দ দূষণের নিয়ন্ত্রন ও এর পরিত্রানের উপায় সম্পর্কে মুন্সীগঞ্জ জেলা পরিবেশ অধিদপ্তরের উপ-পরিচালক মিজানুর রহমানকে জিজ্ঞেস করলে তিনি বলেন, আমরাও পরিবেশ অধিদপ্তর থেকে এ বিষয়ে কাজ করছি। মুন্সীগঞ্জের মুক্তারপুরে অনেক কারখানা আছে যেগুলোর কোন নির্দিষ্ট কাগজপত্র নেই। যে এলাকায় কারখানা হওয়ার কথা নয়, আবাসিক এলাকা সেখানেও কারখানা তৈরি হয়েছে। আমরা এ ধরনের কারখানাগুলো সম্পর্কে জেলা প্রশাসকের কাছে লিষ্ট তৈরি করে পাঠিয়েছি যাতে এগুলো বন্ধ করে দেওয়া হয়। উচ্চ শব্দে মাইক বাজিয়ে গান বাজানো একটি সামাজিক অনাচার। এর জন্য নির্দিষ্ট আইন আছে। আইন মোতাবেক তা নিয়ন্ত্রণ করতে হবে। আপনি একজন সাংবাদিক হিসেবে শব্দ দূষণের জন্য কাজ করছেন জেনে ভালো লাগলো। যখন বিয়ে বা সামাজিক কোন অনুষ্ঠানে এ ধরনের অনিয়ন্ত্রিতভাবে মাইক বাজানো দেখেন। তখন যদি আমাদের বলেন, তাহলে সেই সময়ে আমরা তা আইনের আওতায় এনে বিধিমালা অনুযায়ী বিচারের আওতায় আনতে পারবো।

শব্দ দূষণের নিয়ন্ত্রন ও এর পরিত্রানের বিষয়ে সদর উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা মাহবুবুর রহমানের সাথে সাক্ষাৎকালে তিনি বলেন, পরিবেশ দূষণের একটি বড় কারণ হচ্ছে শব্দ দূষণ। এর জন্য ইদানিং মানুষের শ্রবনশক্তি কমে বধিরতা রোগ বেড়ে যাচ্ছে। বিশেষ করে শিশু ও বৃদ্ধরা এই রোগে বেশি আক্রান্ত হচ্ছে। মুন্সীগঞ্জে জনগনের চেয়ে যানবাহন বেশি। এই যানবাহনের শব্দেও মানুষ অতিষ্ট। লাইসেন্স ছাড়াও অনেক যানবাহন আছে। আমরা তা নিয়ন্ত্রন করছি। এরপর আসে সামাজিক-রাজনৈতিক অনুষ্ঠানের কথা। এসব অনুষ্ঠানে অনেক জোরে মাইক বাজিয়ে উচ্চ শব্দে গান করা হয়। এজন্য পরিবেশ সংরক্ষণ আইন আছে। বিশেষ করে রাতে যদি এই শব্দ হয়, তা আইনের আওতায় এনে তাদের বিধিমালা অনুযায়ী বিচার করতে হবে। আপনারা অনেকে এ ধরনের সামাজিক অনাচার দেখেও আমাদের জানান না। আমরা আইনের আওতার বাইরে যেতে পারিনা। যখন এ ধরনের সামাজিক অনাচার দেখবেন, তখন আমাদের জানাবেন। তা আমরা নিয়ন্ত্রন করার চেষ্টা করবো।

 

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *