সরকারি দফতরের দায়িত্ব অবহেলায়, সুবিধা বঞ্চিত অসহায় মানুষ

সরকারি দফতরের দায়িত্ব অবহেলায়, সুবিধা বঞ্চিত অসহায় মানুষ

কজী বিপ্লব হাসান:  ট্রেডিং করপোরেশন অব বাংলাদেশ (টিসিবি) এর ভতুর্কি মূল্যের কার্ড যাচাই-বাছাই ও বিতরণে নানা অনিয়ম এবং কার্ডের সাথে জড়িত প্রায় সকল সরকারি দফতরের দায়িত্বে অবহেলার কারণে সুবিধা বঞ্চিত হয়েছে এক তৃতীয়াংশ উপকার ভোগী অসহায় দরিদ্র মানুষ। টিসিবির সুবিধাভোগি কার্ডধারীদের তথ্য পরিবর্তন, সংযোজন, বিয়োজন, পরিমার্জনসহ (যদি প্রয়োজন হয়) হালনাগাদ বিভিন্ন তথ্য দেওয়ার ক্ষেত্রে সঠিক নিয়ম অনুসরণ করে যাচাই-বাছাই ও হালনাগাদ করেনি সংশ্লিষ্ট কৃর্তপক্ষ। টিসিবির স্মার্ট কার্ড আনতে গিয়ে কয়েক ঘন্টা লাইনে দাড়িয়ে থেকে হাউমাউ করে কাদতে কাদতে বাড়িতে ফিরেছেন অনেকে। বাতিল হওয়ার পরেও অনেকেই আবার নতুন করে কার্ড পাওয়ার আশায় দীর্ঘ সময় অপেক্ষা করে অবশেষে বাড়িতে ফিরেছেন সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষের সান্তনা নিয়ে। প্রকৃত পক্ষে যারা টিসিবির কার্ড পাওয়ার কথা, তারা অনেকেই বঞ্চিত হয়েছেন নানা রকম ঠুনকো কারনে। ভোটার আইডি ও মানুষ ঠিক থাকলেও শুধুমাত্র মোবাইল নাম্বারের কারণে কার্ড পায়নি অনেকেই। দরিদ্র বয়ষ্ক উপকারভোগী ব্যক্তিদের নিজস্ব মোবাইল না থাকার কারণে পরিবারের অন্য সদস্যদের মোবাইল নাম্বার দেওয়ার কারণে  বাতিল হয়েছে অধিকাংশ কার্ড।

অনেক হত দরিদ্র পরিবার কার্ড পায়নি কিন্তু পরিবারের কয়েকজন উপার্জনক্ষম ব্যক্তি আছে, সন্তানরা দেশের বাইরে থাকে, যাদের অর্থনৈতিক খুবই ভালো তারাও টিসিবিরি কার্ড পেয়েছে। সংশধোন  এক পরিবারে, এক কার্ড হওয়ার নিয়ম থাকলেও একই পরিবারে একাধিক কার্ড পাওয়ার অভিযোগ পূর্ব থেকেই ছিলো। শুধু মাত্র সঠিক তদারকির কারণে প্রকৃত  উপকার ভোগী সুবিধা বঞ্চিত হয়েছে। যার সুবিধা ভোগ করার কথা না, পূর্বের মত তারা ঠিকই সুবিধা নিবে।

বিধবা, নিসন্তান, অন্ধ, লেংড়া, ভিখারি, ভূমিহীন, অসুস্থ্য, নিম্ম আয়ের মানুষের জন্য, পরিসংখ্যান বুরোর জনসংখ্যার দারিদ্র্যতার সূচক, স্থানীয় প্রশাসন, উপজেলা, ইউনিয়ন চেয়ারম্যান, রাজনৈতিক নেতৃবৃন্দ ও জনপ্রতিনিধিদের মাধ্যমে যাচাই-বাছাই করে তালিকা তৈরি করার নিয়ম থাকলেও শুধুমাত্র পৌরসভার দুই একজন কর্মকর্তা কর্মচারি ও পৌরসভায় যাতাযাতকারী কিছু বিশেষ ব্যক্তির মতামত নিয়েই তালিকা করা হয়েছে। পুরনোদের প্রায় এক তৃতীয়াংশের ভাল করে যাচাই-বাছাই না করেই বাতিল করা হয়েছে টিসিবির কার্ড। আবার যাচাই-বাছাই ও হালনাগাদ কার্যক্রমের সময় কখন অতিবাহিত হয়েছে, সেটা অনেক কার্ডধারী জানেই না। সঠিক ব্যক্তি হওয়া সত্বেও কেউ কেউ যাচাই-বাছায়ের সময় কোন কাগজ জমা দিতে হবে সেটাও অবগত করেনি সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষ। ফলে অনেক হত দরিদ্র পরিবার বাদ পড়েছে। সব কিছু সঠিক হওয়ার পরেও সবচেয়ে বেশি বাদ পড়েছে মোবাইল নাম্বার ভিন্ন হওয়ার কারনে। হত দরিদ্র কার্ডধারী ব্যক্তি অনেকইে মারা গেছেন, তবে হালনাগাদের সময় মৃত ব্যক্তির পরিবারের অন্য সদস্যের নামে কার্ড ইস্যু হওয়ার কথা থাকলেও, মৃত ব্যক্তির কার্ড পুরোপুরি বাতিল করা হয়েছে।

সরজমিনে গিয়ে জানা গেছে, এর সাথে সংশ্লিষ্ট কোন প্রতিষ্ঠানই নিজেদেও দায়িত্ব পালন করেনি। একে অপরের কাজের দিকে তাকিয়ে নিজের কাজটি সঠিক ভাবে করেনি। এই দায়িত্ব অবহেলার কারনেই এক তৃতীয়াংশ উপকার ভোগী হযরানি ও সুবিধা বঞ্চিত হয়েছে। তথ্য পরিবর্তন, সংযোজন, বিয়োজন, পরিমার্জনসহ (যদি প্রয়োজন হয়) হালনাগাদ ইউনিয়ন পরিষদ গুলো মোটামুটি দায়িত্ব পালন করলেও মুন্সীগঞ্জ পৌরসভা এ বিষয়ে কোন দায়িত্বই পালন করেনি, তারা টিসিবি কার্ডের কোন কাজই করেনি। মিরকাদিম পৌরসভায় কিছুটা কাজ চলমান আছে। তবে তথ্য পরিবর্তন, সংযোজন, বিয়োজন, পরিমার্জনসহ হালনাগাদে তারাও সঠিক নিয়ম অনুসরণ করেনি।

এ বিষয়ে পঞ্চসার ইউনিয়ন পরিষদের প্রশাসনিক কর্মকতার্ মোঃ কবির হোসেন জানান, আমরা নির্দেশনা অনুযায়ী গ্রামে ও মসজিদেও মাইকে মাইকিং করেছি। যারা বাদ পড়েছে তাদের জন্য যথাযথ প্রক্রিয়া অনুসরণ করে কাজ করা হচ্ছে।

সংযোজন ও হালনাগাদের সময় প্রায় শেষের দিকে আপনাদের কাজের অগ্রগতি কি জানতে চাইলে, মুন্সীগঞ্জ পৌরসভার প্রশাসনিক কর্মকতার্ মোঃ আবদুর রউফ জানান, আমরা এই বিষয়ে কিছুই জানি না। আমাদের কোন চিঠি দেওয়া হয়নি। এমনকি এ কাজ করতে যে আইডি পাসওয়ার্ড প্রয়োজন সেটাও আমাদের দেওয়া হয়নি, কাজ করবো কি করে?

টিসিবি কার্ডের তদারকির বিষয়ে প্রশ্ন করলে উপজেলা নিবার্হী অফিসারের প্রশাসনিক কর্মকর্তা দীনবন্ধু দাস জানান, সংযোজন, বিয়োজন, পরিমার্জনসহ (যদি প্রয়োজন হয়) হালনাগাদ এর কাজ পৌরসভা ও ইউনিয়ন পরিষদের। আমাদের কোন কাজ নেই, তাদের দেওয়া লিষ্ট অনুয়ায়ী আমরা কাজ করি। এ বিষয়ে জেলা প্রশাসক কার্যালয়ের নেজারত শাখা আমাদের কার্ড দেয়। আমরা সেগুলো পৌরসভা ও ইউনিয়ন পরিষদকে বুঝিয়ে দেই।

এই বিষয়ে সদর উপজেলা নিবার্হী কর্মকর্তা মাহাবুবুর রহমান জানান, আমি আসার আগেই এ কাজ হয়েছে। এ বিষয়ে আমার জানা নেই।

এ বিষয়ে জেলা প্রশাসক কাযার্লয়ের নেজারত শাখার প্রশাসনিক কর্মকর্তা কানিজ ফাতেমা জানান, টিসিবির বিষয়ে আমাদের তেমন কাজই নেই। উপজেলা নিবার্হী অফিসারের কার্যালয় থেকে যে লিষ্ট দেয় সেটা আমরা প্রেরণ করে দেই টিসিবির কাছে। আমাদের কাছে কার্ড আসলে আমরা উপজেলা নিবার্হী অফিসে দিয়ে দেই।

প্রাসঙ্গিক, বিগত সরকারের আমলে এই কার্ডকে ব্যবহার করেছে রাজনৈতিক হাতিয়ার হিসেবে। আওয়ামী লীগ নেতারা কখনও দলীয় কর্মীদের পরিবারকে আবার কখনও সুবিধা নেওয়ার মধ্য দিয়ে এক পরিবারকে একাধিক কার্ড দিয়েছে। যে পরিবারে বাবার নামে কার্ড আছে, সেই পরিবারে মায়ের নামেও কার্ড আছে। এ কারণেই বর্তমান অন্তর্বর্তী সরকার টিসিবির ফ্যামিলি কার্ড পুনরায় যাচাই-বাছাই করার সিদ্ধান্ত নেয়। যাচাই-বাছাই ও হালনাগাদ শেষ করে ১৫ নভেম্বরের মধ্যে একটি ফ্রেশ তালিকা তৈরি করে তা বাণিজ্য মন্ত্রণালয়, বিশেষ করে টিসিবিতে পাঠানোর জন্য দেশের সব জেলা প্রশাসককে নির্দেশ দেওয়া হয়েছিলো, পরে সময় আরো বাড়ানো হয়। কিন্তু সংযোজন, বিয়োজন, পরিমার্জনসহ হালনাগাদে যে সকল প্রতিষ্ঠানের উপর তদারকি, তথ্য সগ্রহ ও যথার্যর্থ কাজের মাধ্যমে উপকার ভোগীদের সেবা করার কথা ছিলো। যে সকল কোন প্রতিষ্ঠানই তাদের দায়িত্ব সঠিক ভাবে পালন করেনি।

উল্লেখ্য, মুন্সীগঞ্জ সদর উপজেলায় টিসিবির উপকার ভোগী কার্ডের সংখ্যা মোট ১৩৪২৫ (তের হাজার চার শত পচিশ) টি।  এর মধ্যে ২৯৫০ টি মুন্সীগঞ্জ পৌরসভায়, ১৭২৮ টি মিরকাদিম পৌরসভায় বাকি ৮৭৪৭ (আট হাজার সাত শত সাত চল্লিশ) টি ৯ টি ইউনিয়নে। এর মধ্যে পঞ্চসার ইউনিয়নে ১৭২৮, রামপাল ১০৫৬, বজ্রযোগিনী ৮৪৯, মহাকালী ইউনিয়নে ৭৭৪, চরকেওয়ার ৯৯৮, মোল্লাকান্দি ৯৪৩, আধারা ৯৬২, শিলই ৬৫৯, বাংলাবাজার ৭৭৮ টি। নয়টি ইউনিয়নে বাদ পড়েছে ২৭২৬ টি কার্ড । আর মিরকাদীম পৌরসভায় প্রায় ১১৩৩ এবং মুন্সীগঞ্জ পৌরসভায় প্রায় ১৩০০ কার্ড দিলেও তাদের আইডি ও পাসওয়ার্ডের কারণে একটিভ করতে পারেনি। (তথ্য সংগ্রহ করা পর্যন্ত হিসাব)

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *